আজ ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সংগৃহীত ছবি

শীতে বাড়ে অ্যাজমার প্রকোপ, সতর্কতায় যা করবেন


অনলাইন ডেস্কঃ শীত মৌসুমে ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমার প্রকোপ বেড়ে যায়। এজন্য করণীয় কিছু বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোশাররফ হোসেন

শ্বাসনালির অতি সংবেদনশীলতার কারণে মূলত অ্যাজমা হয়। এতে শ্বাসনালির স্বাভাবিক ব্যাস কমে সরু হয়ে যায়। ফলে ফুসফুসে পর্যাপ্ত পরিমাণ বায়ু যাওয়া-আসা করতে পারে না এবং দেহে অক্সিজেনের অভাব অনুভূত হয়। অ্যাজমার প্রকৃত কারণ আজও অজানা। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জন্মগত ও পরিবেশগত দুটি উপাদানই এর জন্য দায়ী।

শীতে তীব্রতার কারণ
শীতকালে যারা ঘরে বেশিক্ষণ অবস্থান করে, আর যারা ঘরের বাইরে বেশিক্ষণ অবস্থান করে—এই দুই শ্রেণির মানুষের অ্যাজমার প্রকোপ বাড়তে পারে।
আরো যেসব কারণে শীতে অ্যাজমা রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে তা হলো—
বাতাসে ধুলাবালির পরিমাণ বেড়ে গেলে, ঘরে অ্যালার্জেন ও উত্তেজকের মাত্রা বেশি থাকলে, বাড়িতে থাকা কুকুর, বিড়াল বা অন্যান্য পশুপাখি থেকেও প্রকোপ বাড়ে, কাঁথা-বালিশে থাকা ধুলাবালি বা ক্ষুদ্র কীটের সংস্পর্শ, রান্নার চুলার ধোঁয়া (কাঠ কিংবা অন্যান্য জ্বালানি পোড়ানোর কারণে), অ্যালার্জিজনিত অ্যাজমা, খাবারদাবার, কুয়াশা অথবা অতিরিক্ত শীতে ভ্রমণ করা বা ঠাণ্ডাজনিত কারণ ইত্যাদি।

চিকিৎসা
অ্যাজমার চিকিৎসায় ট্যাবলেট, ইনহেলার, ইনজেকশন ও নেবুলাইজার প্রয়োগ করা হয়। কিছু ওষুধ রয়েছে, যা রোগীর শ্বাসকষ্ট তাত্ক্ষণিক দূর করে দিতে পারে। কিছু ওষুধ দীর্ঘমেয়াদে রোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ইনজেকশন ও নেবুলাইজার সাধারণত জরুরি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

ইনহেলার নিয়ে ভুল ধারণা
ইনহেলারই অ্যাজমা রোগের প্রধান চিকিৎসা। দুই ধরনের ইনহেলার ব্যবহার করা হয়। রোগ প্রতিরোধকারী ইনহেলার দীর্ঘমেয়াদি অ্যাজমার লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখে। তবে ইনহেলার ব্যবহারে বেশির ভাগ রোগীর অনীহা থাকে। অনেকের ধারণা, ইনহেলার একবার নিলে এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে যেতে হবে, এটা আর ছাড়া যাবে না। অথচ এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বরং ইনহেলার অত্যন্ত কার্যকরী এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন হিসেবে অনেক গবেষণায় প্রমাণিত, যার তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এতে অত্যন্ত স্বল্পমাত্রার ওষুধ ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে মুখে সেবনের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি।

যদি রোগের তীব্রতা হঠাৎ বাড়ে, তখন সালবিউটামল ইনহেলার সরাসরি বা স্পেসার দিয়ে ৮-১০ বার নিতে হবে। প্রয়োজনে নেবুলাইজারও ব্যবহার করা যায়। বেশি হলে নিকটস্থ ক্লিনিক বা হাসপাতালে যেতে হবে।

করণীয়
কিছু নিয়ম মানলে ও প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করলে অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এই শীতে অ্যাজমা রোগীদের কিছুটা সতর্ক থাকতে হবে। এ জন্য কিছু করণীয় হলো—

সব রকম ধুলাবালি এড়িয়ে চলতে হবে। বিশেষ করে অ্যাজমা আক্রান্ত রোগীর শোবার ঘরটি সব সময় শীতল, শুষ্ক, ধুলা ও মাইটমুক্ত রাখুন। ঘরে যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকে, সে ব্যবস্থা করুন। রাতে ঘুমানোর সময় পর্যাপ্ত উষ্ণতায় থাকুন।

আরও পড়ুন শীতকালীন শাক সবজি ও ফলমূলে রয়েছে বেশি পুষ্টি

স্যাঁতসেঁতে বা ঘিঞ্জি পরিবেশ এড়িয়ে চলুন। অতিরিক্ত গরম বা ঠাণ্ডা পরিবেশ নয়। এসি বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনুন বা এড়িয়ে চলুন।

পুরনো জামাকাপড় ধুয়ে ভালো করে রোদে শুকিয়ে ব্যবহার করুন।

ডাস্ট মাইট কমানোর জন্য ব্যবহৃত বালিশ, তোশক, ম্যাট্রেস ইত্যাদির ধুলাবালি নিয়মিত গরম পানি দ্বারা পরিষ্কার করুন।

মশার কয়েল বা স্প্রে, চুলার আগুনের ধোঁয়া থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন।

গোসলের সময় বা রান্নার সময় অ্যাডজাস্ট ফ্যানটি চালিয়ে রাখুন। ঘরের ফুটো পাইপ ও জানালা ঠিক করুন, যাতে বাইরের ধুলাবালি ঘরে না আসে। দেয়াল ফাটা থাকলে তা-ও মেরামত করুন।

হাত-মুখ সব সময় ধৌত করুন। কারো সঙ্গে করমর্দন করলেও হাত ধুয়ে ফেলুন। নচেৎ চোখ, নাক বা মুখ স্পর্শ করার সময় শরীরে নানা জীবাণু ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে এ সময় ফ্লু ও ঠাণ্ডার প্রকোপ বেশি থাকে। তাই নাক, মুখ, চোখ চুলকানো বা কচলানোর পর ধুয়ে ফেলুন।

যথাসম্ভব নাকমুখ চেপে স্কার্ফ বা মাফলার ব্যবহার করুন। রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় সম্ভব হলে মুখে মাস্ক ব্যবহার করুন।

ঘরে নিয়মিত ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ করুন। সম্ভব হলে ঘরের বাইরে প্রতিদিন ৪০ মিনিট করে সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন দ্রুত হাঁটুন। তবে ঠাণ্ডা মাটিতে খালি পায়ে হাঁটবেন না, সব সময় জুতা-মোজা ব্যবহার করুন।

বাড়িতে থাকা পোষা প্রাণী, বিশেষ করে কুকুর, বিড়াল থেকে দূরে থাকুন। শোবার ঘরের বাইরে তাদের নিরাপদ দূরত্বে রাখুন।

অন্যান্য অসুস্থ মানুষ থেকে দূরে থাকুন। অগ্নিকুণ্ড থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকুন।

শীতের শুরুতেই চিকিৎসক দেখিয়ে অ্যাজমার ওষুধ বা ডোজগুলো ঠিক করে নিন। বিশেষ সতর্কতা হিসেবে সব সময় হাতের কাছেই ইনহেলার রাখুন। একটু ভালো মনে করলে নিজে নিজেই ওষুধ কমিয়ে দিতে পারবেন, তবে একেবারে বন্ধ করা যাবে না।

খাবারদাবার
শীতের সময় কিছু খাবার অ্যাজমা প্রতিরোধে বেশ সহায়তা করে। আবার কিছু খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। এ রকম কিছু খাবার সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন ডায়েট প্লানেট বাংলাদেশের পুষ্টিবিদ মাহবুবা চৌধুরী

পর্যাপ্ত পানি: অ্যাজমা রোগীরা পর্যাপ্ত হালকা গরম পানি পান করবেন। এতে দেহে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা দেখা দেয় না এবং অ্যাজমার প্রবণতা কমে।

রুটি/ওটমিল: সকালের নাশতায় গমের রুটি কিংবা ওটমিল এবং সঙ্গে ডিম খেতে পারেন। এগুলোতে প্রচুর পরিমাণ জিংক রয়েছে, যা শ্বাসনালির প্রদাহজনিত সমস্যা দূর করে।

গাজর ও মুরগির স্যুপ: মুরগির মাংসের প্রটিন আর গাজরের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও বিটাক্যারোটিন ফুসফুস ও শ্বাসনালির জীবাণু ধ্বংস করতে সহায়তা করে।

সবুজ শাকসবজি: সবুজ শাকসবজিতে রয়েছে ভিটামিন ‘সি’, ফোলট (ভিটামিন ‘বি’), খনিজ লবণের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক।

মাছ: মাছের তেলে রয়েছে উচ্চমাত্রার ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, যা শ্বাসতন্ত্র ভালো রাখতে সাহায্য করে। তৈলাক্ত মাছও বেশ উপকারী।

আমলকি: প্রতিদিন একটি করে কাঁচা আমলকী চিবিয়ে খেলে শ্বাসনালির সংক্রমণ থেকে সহজে রক্ষা পাওয়া যায়। কারণ আমলকীতে পর্যাপ্ত ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের নালি খুলে দিতে সাহায্য করে।

রসুন ও কালিজিরা: এতে থাকা প্রচুর পরিমাণ খনিজ লবণ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ফুসফুসের প্রদাহজনিত জটিলতা রোধে বেশ ভালো কাজ করে। ঠাণ্ডা সমস্যায় নিয়মিত খেলে উপকার পাওয়া যায়।

মধু: ১ চা চামচ মধু + আধা চা চামচ গোলমরিচ গুঁড়া + আধা চা চামচ ঘি + ১ চা চামচ পুদিনাপাতার রস মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে দিনে তিনবার খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

চা ও তুলসীপাতা: শ্বাসনালির ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া দূর করে এবং প্রদাহজনিত সমস্যা রোধ করে।

সতর্কতা

বোয়াল মাছ, চিংড়ি মাছ, গরুর মাংস, হাঁসের মাংস, বেগুন, হাঁসের ডিম, কলা, নারিকেল, পনির, ড্রাই ফ্রুট, মাষকলাইর ডাল, সাদা চিনি, ময়দা, অতিরিক্ত তৈলাক্ত ও মসলাজাতীয় খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন।

ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করুন। ফ্রিজের ঠাণ্ডা খাবার নয়, সব সময় গরম খাবার খান।

তথ্যসূত্র: কালেরকণ্ঠ


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর